সীতাকুন্ডের ঘটনায় স্মার্ট গ্রুপকে দায়ী করে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন

আল রাজী কেমিকেল কমপ্লেক্সের অনিয়ম এবং বিএম কন্টেইনার ডিপোর অব্যবস্থাপনার কারণেই ভয়াবহ বিস্ফোরন ঘটেছে বলে মনে করছে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার গঠিত তদন্ত কমিটি।তদন্তে মালিকপক্ষসহ তদারকি সংস্থাগুলোর গাফিলতির প্রমাণও পেয়েছে কমিটি।
গতকাল বুধবার চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিনের কাছে ২৫৯ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেন তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
তদন্ত কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, সব ধরনের ল্যাব টেস্ট করে কমিটি নিশ্চিত হয়েছে ডিপোতে হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ছাড়া অন্য কোনো রাসায়নিকের অস্তিত্ব ছিল না। হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড বিস্ফোরণ থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয় উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘আমরা ১৭ ধরনের নমুনা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের ঢাকা ল্যাবে পাঠিয়ে পরীক্ষা করিয়েছি। তাতে বিএম ডিপোতে অন্য কোনো কেমিক্যালের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। হাইড্র্রোজেন পার অক্সাইড থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।’
তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘তদন্তে গিয়ে আমরা সিসিটিভি ফুটেজ পাইনি, কোনো সফটওয়্যার পাইনি। মালিকপক্ষ জানিয়েছেন এগুলোর কোনো ব্যাকআপ ছিল না। এটা মালিক পক্ষের একটা ব্যর্থতা, কারণ ২০২২ সালে ক্লাউডে বা অন্যত্র কোনো নিরাপদ জায়গায় সিসিটিভি ফুটেজ সেভ থাকবে না এটি আধুনিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যায় না। বিশেষ করে একজন বিদেশি নাগরিক যেখানে এটি মালিক।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “ডিপো কর্তৃপক্ষ তো অবশ্যই দায়ী। কারণ আমার ঘরে আগুন লাগলে আমার দায় অবশ্যই থাকবে। তবে যারা এটি তদরকি করতেন- তারাও তাদের দায়িত্ব অবহেলার বিষয়টি এড়িয়ে যেতে পারেন না।”
মিজানুর রহমান বলেন, তদন্ত করতে গিয়ে কমিটি ফায়ার সার্ভিস, ডিপো কর্মকর্তা ও বেশ কয়েকজন স্থানীয় বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে। প্রাথমিকভাবে দেখা গেছে, যেসব কন্টেইনার থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, সেগুলো রপ্তানির জন্য সিলড করা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড বোঝাই ছিল। আমার ঘরে আগুন লাগলে দায়টা আমারই বেশি। কিন্তু আশপাশে প্রতিবেশী যারা আছেন তাদেরও দায় আছে।
তিনি জানান, বিএম ডিপোর এমডি মোস্তাফিজুর রহমান ও পরিচালক মুজিবুর রহমানকে কমিটি জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং তাদের বক্তব্য রেকর্ড করে। কমিটি তদন্ত কাজ করতে গিয়ে সর্বমোট ২৪ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে ডিপোটির নির্বাহী পরিচালক ব্রি. জেনারেল (অব.) জিয়াউল হায়দার এবং ডিপোর জিএম (মার্কেটিং) নাজমুল আখতার খানকে ডাকা হলেও তারা আসেননি।
ডিপোতে অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের পক্ষ থেকে ৯ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক ও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারকে সদস্য সচিব করে গঠন করা কমিটিকে প্রথমে পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হলেও পরে সময় বাড়ানো হয়। তদন্ত কমিটি এক মাস সময় নিয়ে গতকাল তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সময় কমিটির অন্য সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সব ডিপোর জন্য ২০ সুপারিশ দিয়েছ কমিটি
বিএম ডিপোর ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্য ডিপোগুলোর জন্য সুনির্দিষ্ট ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। এতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে একই প্ল্যাটফর্মে আনারও সুপারিশ করা হয়েছে। কারণ কন্টেইনার ডিপোর অনুমোদন, পরিচালনা এবং তদারকিতে ২৫টি সংস্থার ভূমিকা রয়েছে। সংস্থাগুলোর কাজে সমন্বয়ের কথা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এছাড়া সেখানে বৈধ অবকাঠামোগত প্রয়োজনীয়তা সর্ম্পকে তুলে ধরা হয়েছে। কমিটি ডিজি কার্গো অ্যাক্ট ১৯৫৩ সংশোধনের জন্যও সুপারিশ করেছে। এটি সংশোধন করে আইএমডিজি কোডের সঙ্গে সামঞ্জস্য তৈরির জন্য বলা হয়েছে।
গত ৪ জুন রাত সাড়ে ৯টার দিকে চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে সীতাকুণ্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। আগুন লাগার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ভয়ংকর এক বিস্ফোরণ ঘটে সেখানে। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে ডিপোর বিভিন্ন জায়গায়।
এ ঘটনায় প্রথম দুই দিনে দমকলকর্মীসহ ৪১ জন মারা যান। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় কয়েকজনের মৃত্যু হয় এবং ডিপোতে কয়েকটি দেহাবশেষ পাওয়া যায়। ভয়াবহ ওই অগ্নিকাণ্ডে এখন পর্যন্ত ৫০ এর বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক মানুষ।