বাংলা নিউজ

গভীর সমুদ্রবন্দর

দেশের একমাত্র গভীর সমুদ্র বন্দর হতে যাচ্ছে মহেশখালীর মাতারবাড়িতে।  কিন্তু এই বন্দরের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতা এখনো কাটেনি। গত মে মাসে ভূমির মূল্য চূড়ান্ত হলেও ভূমির শ্রেণি জটিলতায় আটকে রয়েছে অধিগ্রহণ কার্যক্রম। জেলা প্রশাসন বলছে নাল জমি, স্থানীয়রা বলছে লবণ মাঠ ও চিংড়ি চাষের জমি। আর এতেই বিপত্তি দেখা দিয়েছে মাতারবাড়ি বন্দরের ভূমি নিয়ে।
মাতারবাড়ি বন্দরের জন্য প্রথম দফায় ২৮৩ দশমিক ২৩ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য চূড়ান্ত হয় গত মে মাসে। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অধিগ্রহণবাবদ ৭৫ কোটি ১১ লাখ ৫৯ হাজার ২৭৫ টাকা চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। সেই চিঠির প্রেক্ষিতে বন্দর কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনকে সমুদয় টাকা জমা দিয়েছেন বলে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোহাম্মদ আল আমিন পারভেজ নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন,‘ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ টাকা পরিশোধ করলেও আমরা এখনো মাঠ পর্যায়ে জায়গা অধিগ্রহণ শুরু করতে পারিনি। তবে কাগজে কলমে হয়েছে।’ অধিগ্রহণ বিধিমালা অনুযায়ী জমির মালিককে আগে জায়গার মূল্য দিতে হবে। সবাইকে দিতে না পারলেও অন্ততপক্ষে একজনকে হলেও টাকা পরিশোধ করতে হবে। অন্যথায় বাস্তবিকভাবে অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করা যাবে না।

কিন্তু অধিহগ্রহণ কার্যক্রমে জটিলতা ভিন্ন বলে জানান স্থানীয় ধলঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান। তিনি বলেন, ‘আমাদের জমিগুলো নাল (পতিত) হিসেবে চিহ্নিত করে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে স্থানীয়রা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমরা এর বিরুদ্ধে লিখিত প্রতিবাদ জানানোর পর মন্ত্রণালয় থেকে একটি কমিটি করা হয়েছে। এই কমিটি নির্ধারণ করবে এসব জমি নাল না অন্য কিছু ছিল।’
নাল জমি সংক্রান্ত সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আল আমিন পারভেজ বলেন,‘এধরনের একটি সমস্যা রয়েছে। তবে এই সমস্যার কারণে অধিগ্রহণ কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না। কমিটির রিপোর্ট ভূমি মালিকদের পক্ষে গেলে আরো বেশি দাম পাবে। সেটা পরবর্তীতে সমন্বয় করা যাবে।’ এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, অধিগ্রহণকৃত ২৮৩ দশমিক ২৩ একর জমির মধ্যে ২৭৮ দশমিক ৫৫ একর ভূমি নাল জমি। বাকি জমিগুলো বাড়ি, পুকুর, পুকুর পাড় ও রাস্তা হিসেবে রয়েছে।

মাতারবাড়ি ধলঘাট ইউনিয়নের এই এলাকায় যেসব জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে সেগুলোতে বছরের ছয় মাস চিংড়ি এবং ছয় মাস লবণ চাষ হয়ে থাকে বলে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান জানান। তাই এসব জমির অধিগ্রহণের সময় লবণ বা চিংড়ি চাষ হিসেবে জমির শ্রেণি চিহ্নিত করে মূল্য নির্ধারণ করতে হবে এমনটাই দাবি স্থানীয়দের। ধলঘাট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল হাসান বলেন, ‘মহেশখালীতে নাল জমি একর প্রতি সর্বনি¤œ ৩৩ লাখ টাকা হিসেবে নির্ধারণের কথা বলা রয়েছে। কিন্তু এখানে আমাদের ধরা হয়েছে ২৪ লাখ টাকা করে। তবে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ঠিকই ৩৩ লাখ ধরেছে এবং সড়ক ও জনপথ তাদের প্রকল্পে ৫৫ লাখ টাকা করে নির্ধারণ করেছে। তাহলে বন্দর নির্মাণ প্রকল্পে আমাদের কম দেয়া হবে কেন?’

এবিষয়ে সরকারের আইন কি রয়েছে তা জানতে কথা হয় ভূমি মন্ত্রনালয়ের অধিগ্রহণ-২ এর উপসচিব মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন,‘ রেকর্ডে ভূমির শ্রেণি যাহাই থাকুক না কেন অধিগ্রহণের পূর্বে মাঠ পর্যায়ের তদন্তে যা পাওয়া যাবে ভূমির মূল্য সেভাবেই নির্ধারণ হবে।’

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নেয় সরকার। জাইকার অর্থায়নে সেই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে বঙ্গোপসাগর থেকে মাতারবাড়ি পর্যন্ত ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ,  ১৬ মিটার ড্রাফট (গভীরতা) এবং ২৫০ মিটার চওড়া চ্যানেল নির্মাণ হয় বিদ্যুৎ প্রকল্পের আওতায়। ইতিমধ্যে ১৪ মিটার ড্রাফট করাও হয়েছে আগামীতে ‘মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়ন প্রকল্প’ এর আওতায় ড্রাফট ১৬ মিটারে উন্নীত করা হবে। নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্মিত এই প্রকল্পের বাজেট ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি ১৬ লাখ ১৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২ হাজার ৮৯২ কোটি ৭৬ লাখ ৫ হাজার টাকা, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের (নিজস্ব তহবিল) ২ হাজার ২১৩ কোটি ২৪ লাখ ৯৪ হাজার টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২ হাজার ৬৭১ কোটি ১৫ লাখ ১৪ হাজার টাকা। ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। দেশে দিন দিন আমদানী রপ্তানি বাণিজ্য বাড়ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দেশের ৯২ শতাংশ পণ্য আমদানী-রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ১৯০ মিটার দৈর্ঘ্যরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এই বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা ৯ দশমিক ৫ মিটার। তাই বড় দৈর্ঘ্য ও বেশি ড্রাফটের জাহাজ ভেড়াতে মাতারবাড়ির বিকল্প নেই। মাতারবাড়ি চালু হলে এর সাথে চট্টগ্রাম, মোংলা ও পায়রা বন্দরের সাথে নেটওয়ার্ক আরো বাড়বে। কারণ বড় জাহাজগুলো মাতারবাড়িতে পণ্য নিয়ে আসবে। সেখান থেকে ছোটো জাহাজে করে দেশের অন্যান্য বন্দরগুলোতে পণ্য পরিবহন অনেক সহজ হবে। ফলে গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব পূরণ করবে মাতারবাড়ি বন্দর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button